পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে নারী অংশগ্রহণ:
নারীর দক্ষতা উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন
জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি-২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা প্রায় ৯৯ জন। ঘরে-বাইরে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ এবং তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অবস্থান প্রশংসিত। নারী-পুরুষের সমতা (জেন্ডার ইক্যুইটি) প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ সমূহের মিলিত প্রচেষ্টাতে এই অর্জন।
নারী উন্নয়নের অন্যতম সূচক হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। কর্মক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতা প্রমাণ করছেন, কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন। তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ৬০ শতাংশের বেশি, পুলিশ বাহিনীতে ৭ শতাংশ নারী কর্মরত আছেন। দেশের বৃহত্তম সেবা খাত স্বাস্থ্যসেবাতে কর্মরতদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ।
অন্যদিকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশের অধিক মৃত্যু ঘটে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যার মধ্যে অন্যতম, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ২০,০০০ মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। আরও আতঙ্কের বিষয় হল, এর মধ্যে প্রায় ১৪,৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। পানিতে ডুবে মৃত্যু নামক এই নীরব ঘাতক আজ মহামারির রূপ নিয়েছে। কিন্তু সকলের সচেতনতা এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ সম্ভব।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান, যারা বিগত ১৭ বছর ধরে গবেষণাসহ কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রসারে কাজ করছে। তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১-৫ বছর বয়সী শিশুদের সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তত্ত্বাবধানের জন্য শিশুযত্ন কেন্দ্র, ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য সাঁতার প্রশিক্ষণ এবং পানিতে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধারের পর রক্ত সঞ্চালন ও শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার কৌশল ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ৮০ শতাংশ এবং সাঁতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রায় ৯৫ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। এই ব্যবস্থাগুলো স্বল্প খরচে এবং স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় করা সম্ভব যা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের জন্য উপযোগী।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধের এই প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। মাঠ পর্যায়ে মোট পাঁচটি জেলার ছয়টি উপজেলায় প্রায় ২৫০০ শিশুযত্ন কেন্দ্রে ৫০০০ নারী শিশুদের বিকাশ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে শিশু সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রশিক্ষক হিসেবে ২৮৪ জন নারী বরিশাল বিভাগের ২টি জেলার ৩টি উপজেলায় শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এরা সকলেই স্থানীয় কমিউনিটির নারী এবং তাদের এলাকাতে থেকেই তারা এই কাজে তাদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। পানিতে ডুবা প্রতিরোধ কার্যক্রমে কমিউনিটির সচেতনতা বৃদ্ধি ও কমিউনিটির কর্মীদের তত্ত্বাবধানের জন্য যারা রয়েছেন সেখানেও নারী অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এই প্রকল্পে শিশু তত্ত্বাবধানকারিদেরকে অনলাইনে শিশুদের তথ্য সংরক্ষণের জন্য সফটওয়ার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যা তারা দৈনন্দিন শিশু যত্ন কেন্দ্রের তথ্যভান্ডারে ব্যবহার করেন। সামগ্রিকভাবে নারীদের অর্থিক স্বচ্ছলতা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ পরিবার ও স্থানীয় কমিউনিটিতে তাদের গ্রহণযেগ্যতা ও সম্মানজনক অবস্থান দৃষ্টান্ত হয়েছে।
সাঁতার ও পানি থেকে উদ্ধার কৌশল শেখা যেমন পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধের টিকা, তেমনি শিশুর সুরক্ষার জন্য সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান এবং পানি থেকে উদ্ধারের পর সঠিক প্রাথমিক চিকিৎসা কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) ‘মুখে শ্বাস-বুকে চাপ’ কৌশল নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও একজন নারীর অংশগ্রহণ এই কার্যক্রমে উল্লেখ্য। এই নারী বাংলাদেশের ৬৪ টা জেলার মধ্যে ৬৩ টা জেলায় ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি পেশার ১৯ হাজার মানুষকে এই ‘মুখে শ্বাস-বুকে চাপ’ এর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধের উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত রেজ্যুলেশন গ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস’ - এর স্বীকৃতি পেয়েছে ‘২৫ জুলাই’। শুধু আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমে এই নীরব ঘাতককে চিহ্নিত করে কার্যকর প্রতিরোধ উদ্যোগের স্বীকৃতি পাওয়াই নয়; ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন করেছে ”সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রকল্প”। এই প্রকল্পে ৮০০০ শিশুযত্ন কেন্দ্রে শিশুদের বিকাশ ও সুরক্ষসহ ২,০০,০০০ শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
সার্বিকভাবে, দুই দশকে বাংলাদেশে নারীর কর্মসংস্থান প্রায় ৩ ভাগেরও বেশি উন্নতি হয়ে ৩৮ শতাংশে পৌঁছালেও নারীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেনি। আয়মূলক কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণের জন্য নিরাপদ, বৈষম্যহীন এবং সামাজিক সুস্থ্য দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গেও নারীকে খাপ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, তাঁর দক্ষতা উন্নয়নে আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এখানে শিশু মৃত্যু হ্রাস; স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রশমন ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ; শিশুর বিকাশ, সুরক্ষা ও পরিচর্যার নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে অর্জন করার ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের উদ্যোগগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নে নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। কারণ শিশুদের বিকাশ, সুরক্ষা, সাঁতার প্রশিক্ষণ এসকল ক্ষেত্রে শিশুরা নারীদের তত্ত্বাবধানে সহজ ও সাবলীল থাকে। এমনকি কমিউনিটির জনগণও নারী প্রশিক্ষক বা তত্ত্বাবধানকারীর কাছে তাদের শিশুদেরকে তুলনামূলক বেশি সুরক্ষিত মনে করে।
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে নারীদের জীবনমান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নসহ তাদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে তাদের অংশগ্রহণকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকারি-বেসরকারি প্রয়োজনীয় উদ্যোগের বিকল্প নেই।
জুলিয়েট রোজেটি
পলিসি এন্ড পার্টনারশিপ ম্যানেজার,
ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ ডিভিশন, সিআইপিআরবি।