১২ বছরে ১৯ হাজার মানুষকে ফার্স্ট রেসপন্স --

১২ বছরে ১৯ হাজার মানুষকে ফার্স্ট রেসপন্স --
06 Apr 2023
১২ বছরে ১৯ হাজার মানুষকে ফার্স্ট রেসপন্স ট্রেনিং দিয়েছেন শামসুন্নাহার, বাঁচিয়েছেন মানুষের জীবন

 

হার্ট এটাক হলে কিংবা পানিতে ডুবে গেলে যদি কাউকে উদ্ধার করা হয়, তার পরবর্তি প্রথম প্রাথমিক চিকিৎসা হলো কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি পেশার ১৯ হাজারেরও বেশি মানুষকে এই সিপিআর এর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন শামসুন্নাহার, সবার কাছে তিনি পরিচিত নাহার আপা হিসাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়েননি তিনি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কিন্তু মানুষের জীবন বাঁচানোর এই প্রশিক্ষক হতে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।

   

ছয় বোন আর তিন ভাইয়ের মাঝে চতুর্থ নাহারকে এই পথে বাধা দিয়েছেন পরিবারের সবাই। কেবল সাহস জুগিয়েছেন তার চাচা, যার কাছে তিনি বড় হয়েছেন। তারই অনুপ্রেরণায় ২০০৮ সালে  সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ -এ  প্রথম সিপিআর এর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন নাহার। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানটির একটি অন্যতম কাজ পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে কমিউনিটিসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা। তখনো জানতেন না, এই প্রশিক্ষণই তার জীবনের ব্রত হয়ে যাবে একদিন। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক দাতা সংস্থা রয়্যাল লাইফবোট ইন্সটিটিউশন-এর প্রশিক্ষকের কাছ থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নেন ফার্স্ট রেসপন্স ট্রেইনার হবার। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল ইংরেজির বদলে, সাধারন মানুষের বোধগম্য হয় এমন সাবলিল বাংলায় তিনি আয়ত্ত্ব করেন পুরো সিপিআর দেওয়ার কৌশল। তিনি বলেন, “আমি দেখতাম সাধারণ মানুষজন ‘সিপিআর’ বা কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন’ বললে ভড়কে যায়। শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। প্রশিক্ষক আর আমার প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের সাথে আলোচনা করে দেখলাম, পুরো সিপিআর পদ্ধতিটাকে যদি আমি ‘মুখে শ্বাস বুকে চাপ’ বলি তাহলে সহজে বোঝা যায় আর মানুষের মনে রাখাও সহজ হয়। প্রথম দিকে আমার সাথে প্রশিক্ষক হিসাবে যে পেশাদার নার্স বা ডাক্তাররা ছিলেন, তারা এই বিষয়টা ভালভাবে নিতে পারেন নি। কিন্তু একসময় তারাও দেখলেন, এটা বললেই বরং সবাইকে সহজে বোঝানো যাচ্ছে।“

বাংলাদেশের ৬৪ টা জেলার মধ্যে ৬৩ টা জেলায় ঘুরে মানুষকে এই ‘মুখে শ্বাস-বুকে চাপ’ এর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন নাহার। কৃষক, জেলে, শ্রমিক, গৃহিনী, ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে নার্স এমনকি ডাক্তারদেরও প্রশিক্ষক হয়েছেন নাহার। ঢাকার নামি দামী ১৪টি স্কুলের তিন শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, মানুষের জীবন বাঁচানোর এই পদ্ধতি শিখতে লেখাপড়া জানার দরকার নাই। মোটামুটি সাত বছর বয়স থেকে শুরু করে যেকোন বয়সের মানুষই শিখে নিতে পারে এই পদ্ধতি। যখন মানুষের হার্ট এটাক হয় কিংবা পানিতে ডুবে যাওয়ার পর উদ্ধার হয়, তখন সামনে থাকা লোকজনই পারে তার জীবন বাঁচাতে, আর তা এই ‘সিপিআর’ বা ‘মুখে শ্বাস-বুকে চাপ’ পদ্ধতিতে। হাসপাতাল বা ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হবার আগে পর্যন্তে এটাই একমাত্র চিকিৎসা।

প্রশিক্ষক জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় মুহূর্ত কি জানতে চাইলে নাহার জানান, ঢাকার অদূরে মাওয়া ফেরিঘাটে একদিন এক মূমুর্ষূ রোগিকে বাঁচাতে পেরেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে গ্রাম থেকে ঢাকা ফেরার সময় কাঠালবাড়ি থেকে মাওয়া আসছিলেন স্পিডবোটে। মাঝনদীতে দেখতে পান, আরেকটি স্পিডবোট দাঁড়িয়ে আছে, আর যাত্রীরা উদ্ভ্রান্ত। তিনি দেখেন মধ্য বয়স্ক একজন ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে আছেন। তিনি জলদি স্পিড বোট তীরে আনতে বলেন, আর অসুস্থ লোকটির আত্মীয়দের অনুমতি নিয়ে তাকে সিপিআর দিতে শুরু করেন। ঘাট থেকে ঢাকার পান্থপথের একটি হাসপাতালে আসা পর্যন্ত তাকে অনবরত সিপিআর দিতে থাকেন নাহার। শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে বাঁচাতে সক্ষম হন তিনি। নাহার বলেন, সেদিন হাসপাতালের ডাক্তাররাও বলছিলেন, ঠিক সময় সিপিআর দেওয়া না হলে মারা যেতে পারতেন লোকটি বা সারাজীবনের জন্য চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারতেন তিনি।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ-এর সাথে ২০০৬ সাল থেকে যুক্ত শামসুন্নাহার। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তার ফার্স্ট রেসপন্স ট্রেইনার এর যাত্রা শুরু তার। তিনি বলেন, ডাটা কালেক্টর হিসাবে চাকরি জীবন শুরু করেছিলাম। কাজের অংশ হিসাবে ফার্স্ট রেসপন্স ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। কিন্তু সেই এক ট্রেনিংই যে এভাবে ক্যারিয়ারের অংশ হয়ে যাবে তা প্রথমে ভাবিনি। জীবনের লক্ষ্য কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের জীবন বাঁচানোর এই ‘মুখে শ্বাস-বুকে চাপ’ কৌশল তিনি আজীবন মানুষকে শেখাতে চান।

Share this on:

Related Spotlights

Case Story : Sumi Teagarden
17 Aug 2023

Case Story : Sumi Teagarden